হাসিনার বাবুর্চির ভাগ্যবদলের গল্প—অবিশ্বাস্য সম্পদের মালিক এখন

শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ শেখ। ছবি : সংগৃহীত

ঘুরে তাকাতে হয়নি শেখ হাসিনার বাবুর্চিকে, দিনমজুরের ছেলে এখন কোটি টাকার মালিক!দিনমজুর বাবার সন্তান মো. মোশারফ শেখ (৪৭)। পড়ালেখা না করায় নিজের নাম পর্যন্ত লিখতে পারেন না। বাবার সম্পত্তি পেয়েছেন মাত্র ৫ শতাংশ জমি। ৩০ বছর আগে পাবনার এক হোটেলে বাবুর্চি হিসেবে কাজ শুরু করেন। মাত্র দুই বছর চাকরি করার পরই তার ভাগ্যের চাকা ঘুরে যায়। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার বাসায় বাবুর্চির চাকরি পান মোশারফ। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি তাকে।২৭ বছর শেখ হাসিনার বাসায় বাবুর্চি হিসেবে কর্মরত ছিলেন মোশারফ। সেই সূত্র ধরেই এক সময়ের অভাবী পরিবারের সন্তান হয়ে ওঠেন কোটি টাকার সম্পদের মালিক। এখন গ্রামের বাড়ি ফরিদপুরের সালথা উপজেলার ভাওয়াল ইউনিয়নের বড় কামদিয়া ছাড়াও শহরের একাধিক স্থানে রয়েছে জমি, বাড়ি ও গাড়ি।তবে তার এই সম্পদ ও প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অভিযোগ উঠেছে—আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নিজ গ্রামের মানুষদের জমি দখল, হুমকি, মামলার ভয় দেখিয়ে নির্যাতন চালিয়েছেন মোশারফ।সম্প্রতি বড় কামদিয়া গ্রামের কৃষক মো. চাঁনমিয়া ফকিরের ছেলে মো. সাগর মিয়া লিখিত অভিযোগে জানান, আওয়ামী লীগ আমলে মোশারফ ৮১ নম্বর মৌজার ৬১৮ নম্বর দাগের ৪৩ শতাংশ জমি জোরপূর্বক দখল করে সেখানে পাকা ঘর নির্মাণ করেন। জমির মালিক পক্ষ বারবার জমি ছাড়তে বললেও উল্টো হুমকি, মারধর ও হয়রানির শিকার হন তারা। এমনকি জমি উদ্ধারের চেষ্টায় গেলে পুনরায় ভয়ভীতি ও হুমকির মুখে পড়তে হয়।ভুক্তভোগী পরিবারের সদস্য সেন্টু ফকির জানান, “আমার চাচা একজন গরিব কৃষক। শেখ হাসিনার বাবুর্চি মোশারফ আমাদের জমি দখল করে ঘর নির্মাণ করেন এবং তার ওপর একটি নৌকা টানিয়ে রাখেন। আমরা থানায় গিয়েও কোনো বিচার পাইনি। বরং প্রতিবাদ করলেই আমাদেরকে মামলা দিয়ে গ্রাম ছাড়তে বাধ্য করা হতো।”প্রতিবেশী মো. জামাল শেখ বলেন, “মোশারফের বাবা দিনমজুর ছিলেন। মোশারফ ছোটবেলায় এক হোটেলে বাবুর্চির কাজ করতেন। শেখ হাসিনার বাসায় চাকরি পাওয়ার পর হঠাৎ করেই তার জীবন পাল্টে যায়। এখন তার নামে কামদিয়া গ্রামে ২ বিঘা জমির ওপর বাড়ি, মাঠেও রয়েছে ৩ বিঘা জমি। ফরিদপুর শহরের হাড়োকান্দি এলাকায় ১২ শতাংশ জমিতে একটি বাড়ি এবং রাজবাড়ি রাস্তামোড়ে ৮ শতাংশ জমিতে আরও একটি বাড়ি রয়েছে।”তিনি আরও জানান, মোশারফ নিজেই বলেছেন তার নামে ঢাকায় একাধিক ফ্ল্যাট ও প্রাইভেটকার রয়েছে।অনুসন্ধানে জানা যায়, শুধু সম্পদ নয়, গ্রামে প্রভাব খাটিয়ে মোশারফ গড়ে তোলেন ‘ত্রাসের রাজত্ব’। জমি দখল, সালিশ বাণিজ্য, সাধারণ মানুষের ওপর জুলুম ছিল তার নিয়মিত কাজ। যদিও ২০১৫ সালে স্থানীয় যুবলীগ নেতা নুর ইসলামের সমর্থকদের হাতে এলাকা ছাড়তে বাধ্য হন। পরে আবারো প্রতিপক্ষের সঙ্গে মিলে নিয়ন্ত্রণ নেন এলাকায়।বড় কামদিয়া গ্রামের অনেক বাসিন্দাই জানান, মোশারফ শুধু প্রতিবেশীদের ওপরই না, তার নিজের পরিবারের ওপরও অত্যাচার করেছেন। চার বছর আগে দুই মেয়ে ও এক ছেলেকে আটকে রেখে স্ত্রীকে বাড়ি থেকে বের করে দেন। এরপর থেকে তার স্ত্রী আর ফিরে আসতে পারেননি।এই প্রতিবেদনের বিষয়ে মোশারফের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার ফোন বন্ধ পাওয়া যায় এবং গ্রামে গিয়েও তাকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।ফরিদপুর জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হাসানউজ্জামান বলেন, “একজন বাবুর্চি কত বেতন পেতে পারেন? তার সম্পদের পরিমাণ দেখে বোঝা যাচ্ছে, অবশ্যই দুর্নীতির আশ্রয় নিয়েছেন। বিষয়টি তদন্ত হওয়া উচিত।”সালথা থানার ওসি মো. আতাউর রহমান বলেন, “জমি দখলের অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”ক্ষমতার চেয়ারে বসা মানুষের ছায়ায় থেকে কীভাবে এক বাবুর্চি কোটি টাকার মালিক হতে পারে, সেই প্রশ্ন এখন জনমনে। এই ঘটনায় আবারো প্রমাণিত হলো, রাজনৈতিক ক্ষমতা ও প্রভাব যদি দায়িত্বহীন হাতে পড়ে, তাহলে একজন নিরক্ষর বাবুর্চিও হয়ে উঠতে পারে ভয়ংকর প্রতাপশালী ব্যক্তি।

Leave a Reply