
২০২৩ সালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) বাংলাদেশকে মোট ৪.৭ বিলিয়ন ডলারের একটি ঋণ অনুমোদন করেছিল। এই ঋণের আওতায় এখন পর্যন্ত তিনটি কিস্তিতে ২.৩ বিলিয়ন ডলার পেয়েছে বাংলাদেশ। তবে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি নিয়ে আলোচনা কিছুটা স্থগিত ছিল, মূলত বিনিময় হার নির্ধারণের পদ্ধতি নিয়ে মতবিরোধের কারণে।এই পরিস্থিতিতে বুধবার বাংলাদেশ সরকার আইএমএফের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত—বাজারভিত্তিক বিনিময় হার—গ্রহণে সম্মত হয়েছে, যা এই ঋণের স্থগিত কিস্তিগুলো ছাড়ের পথে বড় অগ্রগতি বলে বিবেচিত হচ্ছে।”ম্যানেজড ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট” চালু করার ঘোষণাদুবাই থেকে ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আইএমএফের শর্ত পূরণে বাংলাদেশ এখন থেকে একটি “ম্যানেজড ফ্লোটিং এক্সচেঞ্জ রেট” বা পরিচালিত ভাসমান বিনিময় হার চালু করেছে, যা তাৎক্ষণিকভাবে কার্যকর হবে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন যে, দেশে বর্তমানে ডলারের সরবরাহের পরিস্থিতি বিবেচনায় এই নতুন হারে বড় ধরনের অস্থিরতা তৈরি হবে না এবং এটি বিদ্যমান বিনিময় হারের কাছাকাছি থাকবে।ঋণের কিস্তি ছাড়ের প্রতিশ্রুতিবাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দীর্ঘ কয়েক মাসের আলোচনার পর এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আইএমএফের সঙ্গে বিনিময় হার সংক্রান্ত জটিলতা নিরসন হয়েছে। এর ফলে জুন মাসের মধ্যে চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তির অর্থ ছাড়ের বিষয়ে আইএমএফ ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে।গভর্নর মনসুর আরও জানান, শুধু আইএমএফই নয়, বিশ্ব ব্যাংক (WB), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB) সহ অন্যান্য বহুপাক্ষিক ঋণদাতাদের কাছ থেকেও বাংলাদেশ আগামী জুনের মধ্যে মোট ৩.৫ বিলিয়ন ডলার পাওয়ার প্রত্যাশা করছে। এই অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি নিয়ে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে।বাজারভিত্তিক বিনিময় হার: কী ও কেন?বাজারভিত্তিক বিনিময় হার অর্থাৎ যেখানে মুদ্রার মূল্য নির্ধারিত হয় বাজারের চাহিদা ও যোগানের ওপর ভিত্তি করে, তা সাধারণত অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে আইএমএফ। অতীতে বাংলাদেশ একটি নির্দিষ্ট হারে টাকার বিনিময়ে ডলার বিক্রি করত, যা বাজারের প্রকৃত চাহিদার সঙ্গে সব সময় সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না।আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছিল যে একটি নমনীয় ও বাজারনির্ভর বিনিময় হার গ্রহণ করা হলে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা আরও কার্যকর হবে এবং বৈদেশিক বিনিয়োগও বাড়বে। অবশেষে সেই শর্ত পূরণ করায় আইএমএফের সঙ্গে নতুন করে আস্থা তৈরি হয়েছে।দেশের অর্থনীতির জন্য এর তাৎপর্যএই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সাম্প্রতিক সময়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, ও ডলার সংকটের প্রেক্ষাপটে এই নতুন বিনিময় হার পদ্ধতি কিছুটা স্থিতিশীলতা আনতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর ফলে প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয়ে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে।তবে অনেক অর্থনীতিবিদ এটিও মনে করেন যে, বিনিময় হার একদম বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে দাম হঠাৎ বেড়ে যেতে পারে, ফলে দ্রব্যমূল্যের ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। সেজন্যই “ম্যানেজড ফ্লোটিং” ব্যবস্থা, যাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রয়োজনে হস্তক্ষেপ করতে পারে, এক ধরনের ভারসাম্য বজায় রাখার কৌশল।ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনাবাংলাদেশের জন্য এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হবে এই নতুন বিনিময় হার ব্যবস্থাকে সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করা, যাতে বাজারে আস্থা থাকে এবং অস্থিরতা না তৈরি হয়। একই সঙ্গে আইএমএফের অন্যান্য সংস্কারমূলক শর্ত যেমন কর ব্যবস্থার উন্নয়ন, ব্যয় সংযম, ও ব্যাংকিং খাতের স্বচ্ছতা নিশ্চিত করাও জরুরি।অর্থনীতিবিদদের মতে, এই ধরনের সংস্কারমূলক পদক্ষেপের ফলে দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও টেকসই হবে, যা বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমাবে।